প্রযুক্তির সহায়তায় এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ভাষা সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও ডিজিটাইজেশন জরুরি, কারণ ভাষা মানুষের সাংস্কৃতিক সম্পদগুলোর মধ্যে প্রধান এবং ভাষাবৈচিত্র্য প্রাণপ্রকৃতির জীববৈচিত্র্যের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। ভাষা মানুষের বুদ্ধিমত্তা অর্জন, ধারণ ও বিস্তারণের প্রধান মাধ্যম। এ সত্ত্বেও একের পর এক ভাষার জন্ম ও মৃত্যু ঘটেছে। ভাষাবিজ্ঞানীদের তথ্যমতে, বর্তমান বিশ্বে সাড়ে ছয় হাজারের বেশি ভাষা আছে, যাদের প্রায় অর্ধেক এই চলতি শতকের মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশের বাস্তবতাও এর চাইতে ভিন্ন নয়। সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে বাংলাসহ ৪১টি জীবিত ভাষা আছে। এর মধ্যে ১৪টি ভাষা বিপন্নপ্রায়। এই ধারা অব্যাহত থাকলে অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই এই ভাষাগুলো হারিয়ে যাবে। এরকম পরিস্থিতিতে ভাষাগুলোর বৈজ্ঞানিক ডকুমেন্টেশন প্রয়োজন, যাতে ডিজিটাল যুগে ভাষাগুলোকে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা যায়। বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের অধীনে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল পরিচালিত ‘গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধকরণ’ প্রকল্পের আওতায় দেশের প্রায় সকল ভাষার বৈজ্ঞানিক ডকুমেন্টশন, ডিজিটাল আর্কাইভ, ফন্ট-কিবোর্ড প্রভৃতি উন্নয়নের কাজ শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশের নৃতাত্ত্বিক ভাষা পরিস্থিতি
বাংলাদেশ বহু ভাষা, সংস্কৃতি ও সম্প্রদায়ের সম্প্রীতিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য সুবিদিত। সাংবিধানিক রাষ্ট্রভাষা বাংলা এবং বাংলা ভাষাভাষী বাঙালির পাশাপাশি এই ভূখণ্ডে আরও অর্ধশত ভাষা ও ভাষাজাতি রয়েছে। বাংলার সঙ্গে অপরাপর ভাষাগুলোরও সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণ প্রয়োজন, যেগুলোর অধিকাংশই বিপন্নপ্রায়।
সর্বশেষ নৃতাত্ত্বিক জরিপে ১৪টি ভাষাকে বিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করা হযেছে; যথা কন্দ, খারিয়া, কোডা, সাওরিয়া, মুন্ডা, কোল, মালতো, খুমি, পাংখোয়া, রেংমিটচা, চাক, খিয়াং, লুসাই, লালেং। এগুলোর মধ্যে রেংমিটচার মতো এমন ভাষাও আছে যার মাত্র ৬ জন ব্যবহারকারী বেঁচে আছে, এবং পরবর্তী প্রজন্মের কাছে সেই ভাষা বিভিন্ন কারণে আবেদন ও উপযোগিতা হারিয়ে ফেলেছে। বাকিসব ভাষার কোনটার ব্যবহার সম্প্রদায় পর্যায়ে এবং কোনটা পারিবারিক পর্যায়ে ব্যবহৃত হচ্ছে। এদের মধ্যে ২৬টি ভাষা বিভিন্ন লিপিতে লেখা হয়। সেগুলো হচ্ছে আবেং, আত্তং, মিগাম, বম, লুসাই, পাংখোয়া, খিয়াং, খুমি, ককবরক, ম্রো, মারমা, রাখাইন, চাক, বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরী, মৈতৈ মনিপুরী, হাজং, চাকমা, তঞ্চঙ্গা, সাদরি, উর্দু, মাহালি, কোল, কোডা, খাসিয়া, লিংগাম। লিখিত রূপ থাকা ভাষাগুলোর মধ্যে বাংলা বর্ণমালা ব্যবহার করে ৪টি; যথা, হাজং, সাদরি, কোডা, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি। ৮টি ভাষা নিজস্ব লিপি ব্যবহার করে: মৈতৈ মণিপুরি, চাক, চাকমা, তঞ্চঙ্গা, মারমা, রাখাইন, উর্দু, ও ম্রো। এবং ১৪টি ভাষা রোমান লিপি ব্যবহার করে ; যথা, বম, কোল, ককবরক, খাসিয়া, গারো, লুসাই, মাহালি, পাংখোয়া, আবেং, আত্তং, মিগাম, কোচ, খিয়াং, খুমি। হিসাবমতে, ২৬টি ভাষার লিখিত রূপ আছে, অর্থাৎ ১৪টি ভাষা এখনও লিখিত রূপহীন মৌখিক পর্যায়েই রয়ে গেছে। এই ভাষাগুলো যেমন বিপন্নতার ঝুঁকিতে রয়েছে, একইসাথে লিখিতরূপ থাকা চাক, কোডা, কোল ও পাংখোয়ার মতো কিছু ভাষাও হারিয়ে যাওয়ার বাস্তবতার মুখে আছে। এই নিরিখে লিখিত ও অলিখিত সমস্ত ভাষাকে সঠিক উপায়ে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা না হলে অদূর আগামীতে ভাষাগুলো হারিয়ে যেতে পারে।